আত্তীকরণে গড়িমসি সদ্য জাতীয়করণ কলেজগুলোকে

গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ কলেজ ২০১৬ সালে জাতীয়করণের জন্য সম্মতি পায়। সে বছরই কলেজটিতে গিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের নথিপত্র একবার পরিদর্শন করে আসেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কর্মকর্তারা। তিন বছর পর গত সেপ্টেম্বরে ফের নথিপত্র পরিদর্শনের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষকে মাউশিতে ডেকে আনা হয়। শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্মীকরণের জন্য কাগজপত্র পরিদর্শনের নামে এ পর্যন্ত ওই কলেজ কর্তৃপক্ষকে তিনবার ঢাকায় ডেকে আনা হয়েছে। এখনো কলেজটির শিক্ষক-কর্মচারীরা আত্মীকৃত হননি। ফলে সরকারি হলেও কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না তারা।

ফাইলের মধ্যে সব কাগজ থাকার পরও নরসিংদীর পলাশ শিল্পাঞ্চল কলেজকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কদিন আগে বলা হয়, কলেজ অধিভুক্তির কাগজ দেয়নি। এই কাগজটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। মন্ত্রণালয়ের এমন বার্তা পেয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ যেদিন ঢাকায় আসবে তার আগের দিন ফের তাদের বলা হয়, অধিভুক্ত কলেজের কাগজ পাওয়া গেছে। মন্ত্রণালয়ে আসতে হবে না।

জাতীয়করণ হওয়া কলেজগুলোর শিক্ষকরা বলছেন, এভাবেই কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের অহেতুক হয়রানি করছেন। এতে করে জাতীয়করণ হওয়ার তিন বছর পার হলেও শিক্ষক-কর্মচারীরা এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। এরকম পরিস্থিতিতে সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি (সকশিস) গত ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি পাঠিয়ে দ্রুত আত্মীকরণ প্রক্রিয়া শেষ করার দাবি জানিয়েছে।

দেশের যেসব উপজেলায় অন্তত একটি করে কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি নেই সেসব উপজেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি করে কলেজ ও একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে তিন বছর আগে সরকারি করেছেন। সেই হিসাবে ৩০২টি কলেজ ও প্রায় ৩শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি হয়েছে।

এই সময়ের মধ্যে সরকারি হওয়া প্রায় পৌনে ২শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্মীকরণ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। কিন্তু একইসময়ে একটি কলেজেরও আত্মীকরণ প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। সরকারি হওয়া কলেজের শিক্ষকদের আত্মীকরণের জন্য গত তিন বছর দুই মাস ধরে শুধু নথিপত্র যাচাই করে চলেছেন মাউশি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবুও কোনো কুলকিনারা করা যায়নি।

এর ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বারান্দায় আত্মীকরণের জন্য জমা হওয়া ফাইলের স্তূপ জমে ৫ ফুট উঁচু হয়েছে। আরো কিছু ফাইল মন্ত্রণালয়ে রাখার জায়গা না থাকায় মাউশিতেই পড়ে আছে। এতে প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর দীর্ঘশ্বাস বেড়েই চলেছে। শিক্ষকরা বলছেন, এই সময়ের মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্মীকরণ হলেও একটি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীও আত্মীকরণ হননি।

তবে এসব বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত সোমবার মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুকের কাছে জাতীয়করণ হওয়া কলেজ শিক্ষকদের আত্মীকরণের অগ্রগতি মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে জানাতে নির্দেশ দেন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে শিক্ষামন্ত্রী নিজেই মাউশিতে চলে যান এবং সেখানেই আত্মীকরণের বিষয়ে খবর নেন। মাউশি কর্মকর্তারা এ সময় মন্ত্রীকে নানা গোঁজামিল দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেন, জাতীয়করণের কাজটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সহজেই শেষ হবে না।

জানতে চাইলে সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির (সকশিস) সভাপতি মো. জহুরুল ইসলাম  বলেন, কিছু কর্মকর্তার নানা বাহানা ও দীর্ঘসূত্রতার জন্য সরকারিকরণের সুযোগ-সুবিধা থেকে শিক্ষক-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টরা বঞ্চিত হচ্ছেন। বেসরকারি কলেজ সরকারি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩ বছর ২ মাস পার হয়েছে, তবুও কাজটি শেষ হয়নি। এই সময়ের মধ্যে প্রায় তিন হাজার শিক্ষক কর্মচারী সরকারিকরণের সুযোগ-সুবিধা না পেয়েই অবসরে গেছেন। দ্রুত এই কাজ শেষ না করলে কোনো সুবিধা না পেয়ে আরো কয়েক হাজার শিক্ষক অবসরে যাবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি  বলেন, প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে সরকারি হওয়ায় কাজের চাপ বেড়েছে। তবুও কাজগুলো যাতে দ্রুত শেষ হয় সে জন্য প্রয়োজনীয় জনবল দেয়া হয়েছে। যতদ্রুত সম্ভব কাজগুলো শেষ করা হবে বলে তিনি জানান।

তবে সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির (সকশিস) গত ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী বরাবর যে চিঠি দিয়েছে তাতে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১৭ মে বেসরকারি কোন কলেজকে সরকারি করা হবে তা নির্বাচন করা হয়। একই বছরের ২৮ আগস্ট সরকারি হওয়া কলেজগুলোর নিয়োগ ও অর্থ ব্যয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এরপর সরকারিকরণের জন্য নির্বাচিত বেসরকারি কলেজগুলোতে মাউশির প্রতিনিধি হিসেবে ৮টি আঞ্চলিক অফিসের পরিচালক, উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকের সমন্বয়ে গঠিত পরিদর্শন টিম সরেজমিনে পরিদর্শন করেন এবং পরিদর্শন প্রতিবেদন মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেন। এখন সেই পরিদর্শন প্রতিবেদনকে বিবেচনা আনা হচ্ছে না। ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল সরকারি হওয়া কলেজগুলোতে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ সরকারের নামে হস্তান্তরের জন্য আদেশ জারি করা হয়।

নতুন সরকারি হওয়া কলেজগুলোর শিক্ষকদের যাতে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের মর্যাদা দেয়া না হয় সে জন্য ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ‘নো বিসিএস নো ক্যাডার’ শিরোনামে আন্দোলনে নামেন আগে থেকে সরকারি থাকা কলেজগুলোর শিক্ষকরা। একপর্যায়ে এই দাবিতে ওই বছরের ডিসেম্বরে বিসিএস শিক্ষা সমিতির মহাসচিব মো. শাহেদুল খবীর চৌধুরী ও মো. মঈনুল হোসেন আদালতে রিট করেন। আন্দোলন ও রিটের কারণে ২ বছর ২ মাস ১৪ দিন দেরি করে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই নতুন সরকারিকৃত কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা-১৮ জারি করা হয়। এতে বলা হয়, নতুন সরকারি হওয়া কলেজ শিক্ষকরা নন-ক্যাডার মর্যাদা পাবেন। আগের বিধিতে ক্যাডার মর্যাদা দেয়া হত। এরপর ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের জি.ও. জারি করা হয়।

একই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর সদ্য সরকারি হওয়া কলেজগুলোতে সমন্বিত পদ সৃষ্টি করার জন্য মাউশিকে আদেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা জেলার সদ্য সরকারি হওয়া ৪টি কলেজের তথ্য নিয়ে পরীক্ষামূলক কাজও শুরু হয়। কিন্তু বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) সমিতির মহাসচিব অধ্যাপক শাহেদুল খবীর চৌধুরী মাউশিতে পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) হিসেবে পদায়ন পেয়েই সমন্বিত পদ সৃষ্টির কার্যক্রম বন্ধ করে দেন।

তিনি নতুন ফরমান জারি করে বলেন, নতুন সরকারি হওয়া কলেজের প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক পদ সৃজনের জন্য প্রথমে ২০টি কলেজ ও পরবর্তীতে তিন ধাপে ২৭৯টি কলেজ থেকে তথ্য ছক ও কর্মরতদের ব্যক্তিগত ফাইল তলব করেন। সেই তথ্য ছক ও কর্মরতদের ব্যক্তিগত ফাইল অনুসারে কার্যক্রম পরিচালনা না করে মাউশি ফের ২৯৯টি কলেজের সকল মূল কাগজপত্র যাচাই শুরু করে। নতুন সরকারি হওয়া কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল কাগজপত্র দেখার সময় মাউশি কর্মকর্তারা যেভাবে অহেতুক ও অযাচিত মন্তব্য দিয়ে ফাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছে তা আরো ভোগান্তির জন্ম দেবে।

এসব বিষয়ে মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল খবীর চৌধুরী নিজ দপ্তরে বলেন, নতুন সরকারি হওয়া কলেজগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের নথিগুলোতে নানা ঝামেলা রয়েছে। এর ফলে আত্মীকরণের জন্য নথিগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে যাচাই করতে গিয়ে একটু সময় লাগছে।