শৈশবের উচ্ছ্বাস সমাপনী কেড়ে নিচ্ছে

তারিকুল ইসলাম রনি ও মোমতাহিনা রিয়া, দুজন চাচাতো ভাই-বোন। তারা এবার পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। রিয়া সব বিষয়েই ভালো পরীক্ষা দিলেও, রনির খুব একটা ভালো হয়নি। যে কারণে বাবা-মার বকাঝকাও কম শুনতে হয়নি রনির।

সমাপনী পরীক্ষার আগে রনির দিন কাটত ব‌্যস্ততায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ, পরে তাড়াহুড়ো করে স্কুলে যাওয়া, দুপুরে স্কুল থেকে এসে গোসল, খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুম। ঘুম থেকে উঠে আবার প্রাইভেট পড়া, সন্ধ্যা হলে বাসায় এসে পড়তে বসা। খেলাধুলার জন্য পাড়ার ছেলেদের সাথে মেশারও খুব একটা সুযোগ নেই। এতকিছুর পরও বাবা জানিয়েছেন, সমাপনী পরীক্ষায় ফেল করলে আর পড়াবে না। কাজে দিয়ে দেবে।

মোমতাহিনা রিয়ারও পরীক্ষার আগে রুটিনে সীমাবদ্ধ দিন কেটেছে। শুধু রিয়া-রনিই নয়, সারা দেশে এমন অনেক শিক্ষার্থীরই রুটিনবদ্ধ জীবন। খেলাধুলার সময় কই? যে বয়সে তাদের খেলাধুলা করে বড় হওয়ার কথা, সে সময়ে তাদের পড়াশোনায় কেটে যায় দিন। নিতে হচ্ছে নানা চাপ। পরীক্ষার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবের উচ্ছ্বাস।

শিক্ষাবীদরা বলছেন, প্রাথমিকে সমাপনী পরীক্ষা শিশুদের জন্য একটি মানষিক চাপ। এ বয়সে তাদেরকে জিপিএ-৫ এর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা মেধা বিকাশের কোনো মাধ্যম হতে পারে না। বরং শিক্ষার্থীরা যে সময়ে খেলাধুলা করার কথা ছিল সে সময়ে তাকে গাইড মুখস্ত কিংবা প্রাইভেট মাস্টারের কাছে বসে থাকতে হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, উন্নত বিশ্বে এ জাতীয় কোনো পরীক্ষা হয় না। শিশুদের মেধার ক্রমবিকাশে এটি বড় বাধা। এ সময় একজন শিশুর যে পরিমাণ বিনোদন, খেলাধুলা ও আনন্দ দরকার- এ পদ্ধতির কারণে সেটি অনেকটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

তিনি শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ণয়ে বার্ষিক পরীক্ষাকে সমর্থন দিয়ে বলেন, সব শিক্ষার্থী সমান মেধার হয় না। এক্ষেত্রে তাদের পড়ার মান নির্ণয়ে বার্ষিক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু থাকতে পারে এবং অষ্টম শ্রেণিতে গিয়ে তাকে একটি পাবলিক পরীক্ষার সম্মুখীন করা যেতে পারে।

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন হলে দেশে একটি একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠত। হঠাৎ করে পঞ্চম ও অষ্টমে পাবলিক পরীক্ষার আয়োজন করা হলো। কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী অন্তত পঞ্চম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা হওয়া উচিত নয় মত দিয়েছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

২০১৯ সালের পিইসি পরীক্ষা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনীতে ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষায় বহিস্কৃত হয়েছে ১১৭ জন। এর মধ্যে প্রাথমিকে ২৬ জন এবং ইবতেদায়ীতে ৯১ জন। বহিষ্কৃতদের সবাই ভুয়া পরীক্ষার্থী বলে জানা গেছে এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকেও জানানো হয়েছে। তারা পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল না। তাদের প্রায় সবাই এবারের জেএসসিতে অংশ নিয়েছিল। তারা অন্যের নামে পরীক্ষা দিতে এসেছিল।

কম বয়সী শিশুরা যে এমন অনৈতিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে এটার জন্য কী পদক্ষেপ রয়েছে এমনটা জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) মহাপরিচালক এ এফ এম মনজুর কাদির বলেন, বেসরকারি সাহায্য সংস্থা পরিচালিত স্কুলের শিক্ষার্থী এরা। এদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দেয়া হবে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে মাঠ পর্যায়ে।

এদিকে সমাপনী শুরুর বছর থেকেই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযাগ উঠেছে। এর জন্য তদন্ত কমিটিও করতে হয়েছে। কিন্তু তাও ঠেকানো যায়নি।

এবার প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে সমাপনী পরীক্ষায় বহু নির্বাচনি প্রশ্ন (এমসিকিউ) বাদ দেয়া হয়েছে গত বছর থেকে। এমসিকিউ বাদ দেয়ায় পরীক্ষার্থীদের বৃত্ত ভরাট বা টিক চিহ্ন দেয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ছয়টি বিষয়ের প্রতিটিতে ১০০ নম্বর করে মোট ৬০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে।

এবারের পরীক্ষার শেষ দিনে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ীতে অনুপস্থিত ছিল এক লাখ ৪৮ হাজার ৯০৪ জন পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রাথমিকে অনুপস্থিত ছিল বা পরীক্ষায় অংশ নেয়নি ১ লাখ ৬৪৩ জন। আর ইবতেদায়ীতে অনুপস্থিত ছিল ৪৮ হাজার ২৬১ জন। এরা সবাই সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য নিবন্ধিত হয়েছিল।

এ সংখ্যাটিই ঝরে পড়েছে বলে মনে করছেন প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সম্পৃক্তরা। প্রাথমিক স্তরেই প্রায় উক্ত দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়াকে আশঙ্কাজনক ও হতাশার বলে মন্তব্য করেছেন তারা।

পরীক্ষায় এরা কেন অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকল- এর কোনো ব্যাখ্যা বা জবাব নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা দেশের প্রাথমিক শিক্ষার নিয়ন্ত্রক ও পরিচালনাকারী প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) কাছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা  বলেছেন, সরকারের এত উদ্যোগের পরও বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী অনুপস্থিতি বা ঝরে পড়ে। এটা হতাশাজনক।

পরীক্ষার্থীর অনুপস্থিতির কারণ সম্পর্কে ডিপিই’র মহাপরিচালক এ এফ এম মনজুর কাদির সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘কিছু বেসরকারি স্কুল এবং এনজিওর কারণে এমনটি ঘটছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এনজিওকে চিহ্নিত করতে এ বছর ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাঠ পর্যায়ে তথ্য নেয়ার পর প্রকৃত অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করা হবে এবং স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হবে।’

দেশে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কর্মরত এনজিওগুলোর মোর্চা গণ-স্বাক্ষরতার প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘সমাপনী পরীক্ষা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এতদিন যতটা উৎসব ও আনন্দময় ছিল, এখন এটি ফিকে হয়ে গেছে। কারণ, সমাপনী পরীক্ষা এখন তাদের মধ্যে বোঝা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, সমাপনীকে ঘিরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার- নোট গাইড এবং এক শ্রেণির শিক্ষকের মধ্যে ভয়ানক বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। এগুলোকে সামাল দেয়া রাজধানীর অভিভাবক ও উচ্চ বিত্তের জন‌্য  সম্ভব হলেও, নিম্নবিত্ত ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য এটি এখন বোঝা। এ কারণেই চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে পৌঁছানোর পর অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দিতে পারছেন না। এর ফলে ঝরে পড়ছে বেশি।’

শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকদের দাবি, সমাপনী পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। সমাপনী হলে জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা কেন? আর জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা চালু থাকলে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা কেন? এর যেকোনো একটি পরীক্ষা চালু থাকতে পাবে।

তারা বলছেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পাবলিক পরীক্ষা রাখা উচিত নয়। কোমলমতি শিশুদের আনন্দ পাঠ বা খেলাধুলার মাধ্যমে শেখানো উচিত। জোর করে খুঁদে শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষা চাপিয়ে দিয়ে ভালো কিছু আশা করা উচিত নয়।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বাচ্চাদের শৈশব এখন আনন্দের বদলে বিষময় হয়ে উঠেছে। এটি কখনো মেনে নেওয়া যায় না।