প্রাথমিক শিক্ষকদের দক্ষতা কম এবারের জরিপও বলছে

প্রাথমিক শেষ করেও গণিতের ন্যূনতম জ্ঞান অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে প্রায় ৯০ শতাংশ শিশু। এজন্য শিক্ষকদের দক্ষতার অভাবকেই দুষছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির (নেপ) এক গবেষণায়ও গণিত বিষয়ে পাঠদানে শিক্ষকদের দুর্বলতার কথা উঠে এসেছে। গবেষণার তথ্য বলছে, পাঠদানের ক্ষেত্রে শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষকের কাছেই গণিত একটি কঠিন বিষয়। এসব শিক্ষকের বড়ই অংশই গণিতের কিছু অধ্যায়কে দুর্বোধ্য মনে করেন।

গণিত বিষয়ে পাঠদান সম্পর্কে জানতে গত বছর ময়মনসিংহের ৪০০ শিক্ষক ও কর্মকর্তার ওপর একটি জরিপ চালায় নেপের গবেষক দল। জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে ‘ইফেকটিভনেস অব লেসন স্টাডি: এ কেস অব এনহ্যান্সিং কোয়ালিটি অব ম্যাথমেটিকস টিচিং লার্নিং ইন দ্য প্রাইমারি এডুকেশন অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নেপ।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জরিপে সহকারী শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, ইউআরসি ইনস্ট্রাক্টরসহ মোট ৪০০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা অংশ নেন। জরিপে অংশ নেয়া সহকারী শিক্ষকদের ১৬ শতাংশ শূন্য থেকে পাঁচ বছর, ১৯ শতাংশ পাঁচ থেকে ১০ বছর, ৩৭ শতাংশ ১০ থেকে ১৫ বছর, ৯ শতাংশ ১৫ থেকে ২০ বছর ও ১৯ শতাংশ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে পাঠদানে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের শতভাগই গণিত বিষয়ে পাঠদানকে কঠিন বলে মত দেন।

এছাড়া শিক্ষকদের কাছে গণিত বিষয়ে পাঠদানকে কঠিন অনুভূত হয় বলে মত দিয়েছেন ৭৫ শতাংশ প্রধান শিক্ষক। আর জরিপে অংশ নেয়া সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও ইউআরসি ইনস্ট্রাক্টরদের শতভাগই বলেছেন, শিক্ষকরা গণিতে পাঠদানের ক্ষেত্রে ডিফিকাল্টি অনুভব করেন।

 

শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা বলছেন, চিন্তাশক্তি ও যৌক্তিক ক্ষমতার বিকাশে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গণিত। প্রতিটি শিক্ষা ব্যবস্থায় এ বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। যদিও দেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা- সব স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের গণিতভীতি রয়েছে। বিশেষ করে এ ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে প্রাথমিক থেকেই।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গণিত সমিতির সহসভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশের গণিত শিক্ষায় মূলত তিনটি দুর্বলতা রয়েছে। প্রথম বিষয়টি হলো- প্রাথমিকের গণিত বইটি আসলেই দুর্বোধ্য। আমরা গণিত সমিতির পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়ে বইটি সহজ করে লেখানোর জন্য বলেছি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় না নিয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক মানদণ্ডে বইয়ের লেখক ঠিক করা হয়। দ্বিতীয় দুর্বলতাটি হলো, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব। এ বিষয়টি খুব জরুরি। আপনার শিক্ষকরা যদি নিজেরাই একটি বিষয় সমাধানের সুস্পষ্ট জ্ঞান না রাখেন, তাহলে ছাত্রছাত্রীদের কী শেখাবেন? আর তৃতীয় বিষয়টি হলো- শিক্ষার্থীদের কাছে গণিত শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করে তুলে না ধরা।

জরিপে অংশ নেয়া শিক্ষকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়- গণিত বিষয়ে পাঠদানের ক্ষেত্রে কঠিন বিষয়গুলো কীভাবে সহজে উপস্থাপন করেন তারা? ২৫ শতাংশ সহকারী শিক্ষক জানান, এক্ষেত্রে তারা সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এছাড়া ৫৯ শতাংশ শিক্ষক টিচিং এইডস ও ৯ শতাংশ শিক্ষক টিচারস এডিসন ব্যবহার করেন। ৪৭ শতাংশ শিক্ষক জানান, তারা কঠিন বিষয়টি শিক্ষার্থীদের দিয়ে বারবার অনুশীলন করান। তবে কোনো সহকারী শিক্ষকই এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক, সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও ইউআরসি ইনস্ট্রাক্টরের সঙ্গে আলাপ করেন না বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

গণিত বিষয়ের কোন অধ্যায়গুলো কঠিন মনে হয়?- এমন প্রশ্নের উত্তরে ৪৪ শতাংশ সহকারী শিক্ষক জানান, তাদের কাছে গণিতের ভগ্নাংশ ও এডিশন অ্যান্ড সাবট্রাকশন উইথ ক্যারি অংশ দুর্বোধ্য মনে হয়। আর দশমিক, ভগ্নাংশ, পরিমাপ ও গুণ এবং গুণকের অংক দুর্বোধ্য মনে করেন ২৫ শতাংশ সহকারী শিক্ষক। গুণ-ভাগের অংক করাতেও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েন শিক্ষকদের বড় একটি অংশ। ৪১ শতাংশ সহকারী শিক্ষক বিষয়টি জটিল বলে মতামত দেন। এছাড়া শতকরা হিসাবের অংক ৩ শতাংশ, জ্যামিতি ও শব্দ সমস্যা ৯ শতাংশ সহকারী শিক্ষকের কাছে দুর্বোধ্য বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

একই প্রশ্ন রাখা হয় প্রধান শিক্ষকদের কাছে। তাদের ক্ষেত্রে চিত্রটি হলো, ভগ্নাংশ ও এডিশন অ্যান্ড সাবট্রাকশন উইথ ক্যারি অংশ দুর্বোধ্য মনে করেন ৩৮ শতাংশ শিক্ষক। আর ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রধান শিক্ষক বলছেন দশমিক ভগ্নাংশ, পরিমাপ, গুণ-ভাগ ও গুণ এবং গুণকের অংক তাদের কাছে দুর্বোধ্য। এছাড়া শতকরা হিসাব ও জ্যামিতিকে জটিল হিসেবে মতামত দিয়েছেন ২৫ শতাংশ প্রধান শিক্ষক।

শিক্ষকদের গণিতে দুর্বলতা বিষয়ে গবেষক দলের সদস্য নেপের সহকারী বিশেষজ্ঞ মো. মাজহারুল ইসলাম খান বলেন, পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন বিষয় আসে। এজন্য শিক্ষকদের নতুন কারিকুলাম প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে সব শিক্ষককে এ প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হয় না। এজন্য তারা ওই বিষয়টিকে কঠিন বলে মনে করতে শুরু করেন। তাই পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার বিষয়টি জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষকরা যদি নিজ উদ্যোগে চেষ্টা ও অনুশীলন করেন, তাহলে নিজেরাই অনেক সমস্যা সমাধান করে ফেলতে পারেন।

শিক্ষকদের গণিতের এ দুর্বলতার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপরও। তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের গণিতে দক্ষতা যাচাইয়ে প্রতি দুই বছর অন্তর একটি জরিপ চালায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন বিভাগ। সর্বশেষ জরিপটি পরিচালিত হয় ২০১৭ সালে। এ জরিপে সারা দেশের প্রায় তিন হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ২৮ হাজার ৪০২ জন শিক্ষার্থী ও পঞ্চম শ্রেণির ২৪ হাজার ১৪৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। জরিপের ফলাফল যাচাই-বাছাই শেষে গত বছর প্রকাশ করা হয় ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্টস অ্যাসেসমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের গণিতে দুর্বলতার চিত্র উঠে আসে।

গণিতে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা যাচাইয়ে চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয় জরিপে। বিষয়গুলো হলো- সংখ্যা, পরিমাপ, আকার ও পরিধি এবং তথ্য-উপাত্ত। নির্দিষ্ট শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপযোগী করেই প্রশ্নগুলো করা হয়। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা হয় ৩৫টি। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সামনে প্রশ্ন ছিল ৪০টি। এর মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের জ্ঞান, চিন্তার ক্ষমতা, বোধগম্যতা ও প্রায়োগিক ব্যবহারের দক্ষতা পরিমাপ করা হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স বিষয়ে বলা হয়েছে, তৃতীয় শ্রেণির মাত্র ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী সন্তোষজনক পর্যায়ে উত্তর দিতে পেরেছে। আর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ফলাফলে দেখা যায়, মাত্র ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী সন্তোষজনক পর্যায়ে উত্তর দিতে পেরেছে। এ হিসাবে ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীই গণিত বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান অর্জন ছাড়াই প্রাথমিক সম্পন্ন করছে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, গণিতের ভালো শিক্ষক না থাকায় এমনটি হচ্ছে। শহর অঞ্চলের বিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষক থাকায় সেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্সও ভালো। আবার অন্যদিকে চা বাগান কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলে দেখা যাবে ভালো শিক্ষক নেই, শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্সও খারাপ। তাই আমাদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সরকারকে বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। এছাড়া শ্রেণিভিত্তিক পাঠদানে শিক্ষকদের মধ্যেও দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।

প্রসঙ্গত, এর আগেরাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ‘ব্র্যাক শিক্ষাতরী’ বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেছিলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পারফরম্যান্স ব্র্যাকের এসএসসি এইচএসসি পাস করার শিক্ষকদের থেকেও খারাপ।

তিনি আরো বলেন, একবার এক পিটিআইতে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে আমি বলেই ফেলেছিলাম, আপনার (সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকরা) চারজন শিক্ষক মিলে একজন শিক্ষকের সমান কাজ করুন। ব্র্যাকের শিক্ষকরা ভালো কাজ করেন, কারণ মনে হয় কর্তৃপক্ষ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পেরেছেন। কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মনে করেন একবার সরকারি চাকরি পেয়ে গেছেন তো আর কিছু লাগবে না। একদম ‘সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল’।