ছোট গল্প ‘বিচার’
জমলু গায়ের ছেঁড়া কাপড়টা দিয়ে কোনো রকম গতর ঢাকার চেষ্টা করে, এই এক জ্বালা, মাথায় দিলে গা ঢাকা পড়ে না, গায়ে দিলে মাথায়। ছমছু মিয়ার গলা শোনা যায়। ছমছু ঠেলাগড়িটা শিমের মাচার পাশে রেখে হাক ছাড়ে, " কইরে কদবানু, পানি দে একগ্লাস"।
কদবানু পাখায় ফুল তোলার চেষ্টা করছিল, অসময়ে বাবার ডাক শুনে পড়িমরি করে পানি নিয়ে আসে। ছমছু মিয়া একঢোকে পানি শেষ করে। "কী গো আম্মা, আপনাগো ইস্কুল কোনদিন খুলব? মাস্টার;সাবেরা কিছু কয় না?" কদবানু আড়চোখে মায়ের দিকে তাকায়, বাবার সঙ্গে বেশী কথা বলা জমলুর পছন্দ না, তাই মাথা নেড়ে নাসূচক জবাব দিয়ে চুপচাপ ঘরে চলে যায়।
জমলু হাতের কাজ ফেলে তেড়ে আসে, " মাইয়ারে কী পণ্ডিত বানাইতে চাও? এইট কেলাস পাশ দিছে, যথেষ্ট অইছে। অহন যে ঘর আইছে, চুপচাপ মাইয়ারে ওইহানে বিয়া দাও। ছেলে বিদেশ চাকরি করে, মাইয়া থাকব ভালা।" ছমছু মিনমিন করে বলে, " পোলাডার বয়স একটু বেশী ময়নার মা।" "তাইতে কি অইছে? বেটা মাইনসের বয়স কোনো হিসাবে দরে? মাইয়া সুখে থাকলেই অইল।" কথা হচ্ছে, কদবানু এইট পাশ করে নাইনে উঠেছিল, করোনার জন্য স্কুল বন্ধ সারাবছরই বলতে গেলে।
কবে খুলবে ঠিক নাই, ঘরে আরও তিনটে মেয়ে। কদবানুরে বিয়ে দেওয়া দরকার, মেয়ে মানুষের বয়স হুট করে বেড়ে যায়। কদবানুর বয়সও ষোল পার হয়ে সতেরোতে পড়ল বলে। কদবানুর মা মারা যাওয়ার পরের বছরই জমলুকে বিয়ে করে আনে ছমছু। ছমছুর কপালই খারাপ, চার চারটা মেয়ের বাপ হয়েছে, এদিকে অভাবও ছাড়ে না। ঠেলাগাড়ি দিয়ে মাল টেনে অভাব দূর হয়না। মেয়েটা উপবৃত্তি পায়, কোনোরকম পড়াশোনা করে, কিন্তু আর বুঝি চলে না। এর মাঝে এই প্রস্তাবটা তেমন খারাপ না। দিন দেখে কলমা পড়িয়ে কদবানুর বিয়ে হয়ে গেল প্রবাসী কাছুমিয়ার সাথে। তিনমাস কাছুমিয়া দেশে থেকে প্রবাস পাড়ি জমায়। কদবানু শ্বশুরবাড়িতেই থাকে।
শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ি নাই, আছে কেবল শ্বশুর আর তিনটা দেবর। ননদ দুইটার বিয়ে হয়েছে বাড়ির পাশেই। কাছুমিয়া টাকা পাঠায় আর সবাই ফুটানি মেরে খায়, কদবানু বাড়ির সব কাজ করে। কদবানুর শরীর ভারি, কিন্তু সেই দিকে কারো নজর নাই। এইদিকে হয়েছে আরেক যন্ত্রণা, সোমত্ত তিন দেওরের লোভী চোখ কদবানুর শরীরের দিকে পড়ে। মা নেই, কাকে বলে! ননদ দুইটাকে বলতে গিয়ে মার খেতে বাকি ছিল শুধু। উল্টো কদবানুকে যা খুশি বলে তারা। সেদিন ছিল তুমুল বৃষ্টি, শ্বশুর গঞ্জে গেছেন। কদবানুর শরীরটা আজ কিছুতেই ভাল লাগছে না।
মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। আজ যদি মা বেঁচে থাকত! তার বাবা বিয়ে দিয়ে একবার মাত্র এসে নিয়ে গিয়েছিল, আর কোনো খুঁজও রাখেনি। কদবানু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুলায় আগুন ধরায়। হঠাৎ কিসের শব্দে চমকে ওঠে সে। একজোড়া লোভী চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার স্বামী কাছুমিয়া যাবার পর থেকে প্রায় রাতেই তাকে অমানবিক কিছু অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়। পেটে বাচ্চা, যাবার জায়গা নেই। কদবানুকে একেকরাতে একেক ভাইয়ের সঙ্গে রাত কাটাতে হয়। কাছুমিয়াকেও বলতে পারেনা কিছু। সে যখন মোবাইল করে ননদেরা পাশে থাকে, কিছুই বলতে পারে না কদবানু। কদবানু দেখে মেঝোটা তাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে, এখনি ঝাপিয়ে পড়বে যেন। এদিকে বাচ্চা পেটে, পরিশ্রমে অযত্নে কদবানুর শরীর কাহিল। জানোয়ারটা কদবানুর উপরে ঝাপিয়ে পড়তেই সে চুলায় সদ্য ধরানো কাঠের টুকরোটা দিয়ে জোরে বাড়ি দেয়, বেহুশে জানোয়ার টের পায়নি প্রথমে কিছু।
আগুন যখন কাপড় ছেড়ে শরীরে ধরল, কদবানুকে ছেড়ে লাফ দিয়ে দৌড় দিল, যত দৌড়ে আগুন তত বাড়ে। কদবানুর শরীরেও আগুন ধরেছে, নির্বিকার কদবানু যেন বোধশূন্য। কাছুর বাপ গঞ্জ থেকে ফিরেছে যখন সারাবাড়ি পুড়ে গেছে। দুইটি পোড়া লাশ সামনের উঠানে, পাড়াপড়শিরা কোনোরকমে আগুন নিভাতে পারলেও ঘরটা বাঁচাতে পারেনি, মানুষ দুইটাকেও না। পোড়া লাশ কার, চেনা যায় না। পাপ আগুন হয়ে সব পুড়িয়ে দিয়েছে। কাছুমিয়ার ভাই আর বউ আগুনে পুড়ে মরে গেছে, সবাই জানল। শুধু বিধাতাই জানেন আসলে কী ঘটেছিল।
রুবি বিনতে মনোয়ার