বাড়ছে অপরাধ প্রযুক্তির অপব্যবহারে

তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে এলেও এর অপব্যবহার ঘটছে ভয়াবহরূপে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার ফলে নিত্যনতুন অপরাধের ধরনও শিখছে দুর্বৃত্তরা। এর ফলে দেশে আশঙ্কাজনক হারে হত্যা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজিসহ ছোট-বড় নানা অপরাধ বাড়ছে। আর এসব অপকর্মে জড়িতদের বড় অংশই উঠতি বয়সী।

বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারকেই তাদের বিগড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর সারাদেশে পাঁচ শতাধিক মামলা হচ্ছে কিশোর অপরাধসংক্রান্ত। সম্প্রতি মামলার সংখ্যা কিছুটা কমলেও কিশোরদের অপরাধের ধরন বেড়েছে। প্রতিবছর দুই শতাধিক ঘটনা থাকছে হত্যা ও ধর্ষণসংক্রান্ত। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় কিশোরদের একটি অংশের বেপরোয়া আচরণ স্থানীয়দের জন্যও আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে।

প্রথমদিকে এরা ইভটিজিং বা বখাটেপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও সম্প্রতি খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কেনাবেচা, ধর্ষণ এবং দলবেঁধে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

সূত্রমতে, ভার্চুয়াল মাধ্যমে গ্রুপ সৃষ্টি করে সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়ানো কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা খোদ রাজধানীতেই অর্ধশতাধিক। গ্যাংগুলো উদ্ভট সব নামে পরিচিত। আড়াই বছর আগে উত্তরার আদনান কবির হত্যার পর এই ‘গ্যাং কালচারের’ বিষয়টি সামনে এলেও এখন ব্যাপ্তি বেড়েছে। ১৫-১৭ বছর বয়সী প্রতিটি গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ১৫-১৭ জন। তবে ১৮-২৪ বছর বয়সী গ্রুপও রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামপ্রতিক অভিযানে বেশ কয়েকটি গ্যাংয়ের কিশোর অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এ ক্ষেত্রে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি জরুরি।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাই যথেষ্ট নয়, চূড়ান্ত দাওয়াই হচ্ছে অভিভাবকদের সচেতনতা। এদিকে কিশোর অপরাধের বিস্তার ঘটেছে গ্রামপর্যায়েও। তারা ইন্টারনেট থেকে নানা অপরাধের খোরাক পাচ্ছে। টেলিভিশন সিরিজ থেকে জেনে নিচ্ছে কৌশল। দেখা যায়, এরা বেশির ভাগই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। তারা মাদকসেবনের টাকা জোগাতে গিয়েও করছে বড় ধরনের অপরাধ। মা-বাবাকেও হত্যার অভিযোগে আটক রয়েছে অনেক কিশোর-কিশোরী।

সূত্র জানায়, দেশে বছরে কিশোর অপরাধের ঘটনায় ৫ শতাধিক মামলা হচ্ছে। সম্প্রতি মামলার সংখ্যা কিছুটা কমলেও বেড়েছে অপরাধের ধরন। প্রতিবছর হত্যা ও ধর্ষণ সংক্রান্ত ২ শতাধিক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। অজপাড়াগাঁওয়েও এখন এদের বিস্তার।

সূত্র বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের বেশির ভাগ সদস্যই পরিবার থেকে কোনো না কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন। এদের মধ্যে অনেকেই আবার মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়েও জড়াচ্ছে অপরাধে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক পরিবার রয়েছে যারা দ্রুতই অনেক টাকা-পয়সার মালিক হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। ফলে সন্তানকে সুপথে পরিচালিত করার পর্যাপ্ত যোগ্যতা ও দক্ষতা নেই তাদের। এসব পরিবারের কিশোররা বেশির ভাগ অপরাধে জড়িত হচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহারের প্রভাবে।

অন্যদিকে ছিন্নমূল ও সহায়হীন অনেক কিশোরও জড়িত হচ্ছে নানা অপরাধে। অভিভাবকহীন অবস্থায় ছোটবেলা থেকেই অপরাধ জগতের সঙ্গে বেড়ে ওঠায় ওরা নানা ধরনের অপরাধ সংঘটন করছে। আর ফেসবুক, ভিডিও গেমসহ নানা কিছুর যথেচ্ছ ব্যবহারেও কিশোররা অপরাধে জড়াচ্ছে।

এ ছাড়া অনেক মা-বাবা আছেন, সন্তান কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে, ইন্টারনেটে কী দেখছে সে সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন না। মনে করেন টাকা দিলেই সব দায়িত্ব শেষ। যারা এমন মনে করেন, তাদের সন্তানদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিপার্শ্বিক নানা কারণে অনেক আগে থেকেই অপরাধী তালিকায় নাম এসেছে অল্পবয়সীদের। তবে নব্বইয়ের পর খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনাতেও জড়াচ্ছে স্কুলপড়ুয়া কিশোররা। তাদের যথাযথ পরিবেশ দিতে না পারা ও পরিবার, বিদ্যালয় কোথাও প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও পরিবেশ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সার্বিকভাবে শিশুরা বেড়ে উঠছে আগ্রাসী মানসিকতা নিয়ে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। কঠোর আইনি পদক্ষেপ দিয়ে সাময়িক দমন হলেও কিশোর অপরাধের প্রতিকার হয় না। পরিবার ও সমাজে যদি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ থাকে তাহলে কিশোররা অপরাধমূলক ঘটনায় কম জড়াবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক বলেন, পরিবারের অভিভাবকদের উদাসীনতার কারণে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। বাড়ছে তারুণ্যের অবক্ষয়ও। বর্তমান রাজনীতি ও অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজও এ জন্য কম দায়ী নয়। সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়, বেকারত্ব, অনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, অনলাইন প্রযুক্তির কুপ্রভাব, পর্নোগ্রাফির প্রসার, অনৈতিক জীবনযাপন, পাচার, বিরোধ-শত্রুতা, ব্যক্তি স্বার্থপরতা, লোভ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ জন্য দায়ী। এ অবস্থার জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থাও কম দায়ী নয়। তিনি বলেন, পরিস্থিতি পাল্টাতে হলে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনকে আরও জোরদার, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে কাউন্সিলিং, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ছাড়াও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে আরও সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। কিশোরদের পরিবার সময় দিচ্ছে না। হাতে তুলে দিচ্ছে মোবাইল। ইন্টারনেটের আসক্তির ফলে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে তারা। সেখানে অপরাধের নানা কৌশল শিখছে। বিভিন্ন পর্নোসাইটে তারা প্রবেশ করছে। এ ছাড়া যত ধরনের ভিডিও গেম আছে প্রায় সবই যুদ্ধ, মারামারিবিষয়ক। অল্প বয়সে খুন, মারামারি, এসব বিষয়ের সঙ্গে একজন কিশোর পরিচিত হচ্ছে। এ ধরনের গেমগুলো কিশোর মনে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে।