প্রতিবন্ধীদের প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক বিশ্বজুড়ে

আজ ৩ ডিসেম্বর, ২৯তম আন্তর্জাতিক ও ২২তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত এ দিবসটি ১৯৯২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘আরো ভালো পুনর্গঠন একটি অক্ষমতা-অন্তর্ভুক্তিমূলক, সুগম ও টেকশই কোভিড-১৯ পরবর্তী পৃথিবীর দিকে।

প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে সচেতনতার প্রসার ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মর্যাদা সমুন্নতকরণ, অধিকার সুরক্ষা ও উন্নতি সাধন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক সনদ (ইউএনসিআরপিডি) প্রতিবন্ধিতাকে একটি নতুন ধারণা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, এতে বলা হয়েছে- ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা হলেন তারা, যাদের দীর্ঘ মেয়াদি শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত ও ইন্দ্রিয়গত বৈকল্য রয়েছে, যা অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমাজের অন্যদের তুলনায় সমতার ভিত্তিতে তাদের পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণে বিঘ্ন ঘটায়।

প্রতিবন্ধিতা আবার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কেউ বাকপ্রতিবন্ধী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, শ্রবণপ্রতিবন্ধী, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিংবা শারীরিকপ্রতিবন্ধী। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২০১১ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি ৪৭ লাখেরও বেশি মানুষ প্রতিবন্ধী। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। এই বিশাল সংখ্যক জনগণকে বাদ দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো একেবারেই সম্ভব নয়।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সব মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০০৭ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষর করে ও এরই আলোকে ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন পাস করা হয়। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন এনজিওগুলো প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য যে কর্মকান্ড শুরু করেছে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও আমরা এর ইতিবাচক সূচনাকে স্বাগত জানাই। এত ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলেও আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কটুলতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবের কারণে প্রতিবন্ধীদের পূর্ণ অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষিত হচ্ছে না। প্রায়শই সভা-সেমিনারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিয়ে অনেক সোচ্চার হওয়ার কথা দেখা যায়। কিন্তু বস্তুত এগুলো অর্থহীন এক গাদা নিরর্থক বাণীতে পরিণত হয়েছে। 

আমরা আজও প্রতিবন্ধী মানুষের উপর থেকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে উঠতে পারিনি। দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সভা, সেমিনার, পত্রিকা, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি পারিবারিক পর্যায়ে সর্বত্রই ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটির ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও এই ধারণা বদ্ধমূল রয়েছে যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মাত্রই অক্ষম, অকেজো, অযোগ্য। আমাদের দেশের অনেক অভিভাবক আজও মনে করেন কোনো পাপের ফলেই তার সন্তান প্রতিবন্ধী হয়েছে। প্রতিবেশীরাও সংস্কারবশত এমন ধারণাই পোষণ করে। ফলে প্রতিবন্ধী ও তাদের পরিবারকে সামাজিকভাবে উপেক্ষা ও অবহেলার শিকার হতে হচ্ছে। সম্মান ক্ষুন্ন হওয়ার ভয়ে প্রতিবন্ধীদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। 

সাধারণভাবে আমাদের সমাজ ধরেই নেয় যে এরা সমাজের পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়। ফলে এই মানুষগুলো যতটা না শারীরিক দিক দিয়ে অনুপযুক্ত, তার চেয়ে ঢের অনুপযুক্ত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে। অথচ এই মানুষকে ‘অন্যভাবে সক্ষম’ নামক সুন্দর একটি পরিচয় দেওয়া যায়। এটি যে কাগজে কলমে করতে হবে এমন কথা নয়, বরং আমাদের মননে এটা ধারণ করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিবন্ধিতা কোনো অভিশাপ নয়। প্রতিবন্ধীদের জন্য সমসুযোগ, সমঅধিকার, শিক্ষা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদানের সুযোগ করে দিলে তারাও সমাজে, অর্থনীতিতে ও সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম। আমাদের পশ্চাৎপদ সমাজব্যবস্থা তাদেরকে বোঝা, অবমূল্যায়ন  ও অনুগ্রহের পাত্র বানিয়ে রেখেছে। প্রতিবন্ধীরা আমাদের পরিবারের সদস্য, সমাজের মানুষ ও রাষ্ট্রের নাগরিক। তাদেরকে সব নাগরিক অধিকার দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। তাদের ভিন্ন চোখে দেখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। কারণ তারা করুণা নয়, চায় তাদের ন্যায্য অধিকারটুকু। 

একটু ইতিবাচক পরিবেশ পেলে তারাও সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমগ্র বিশ্বের জন্য হয়ে উঠতে পারেন অনুকরণীয় আদর্শ। এজন্য প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায় থেকে মনোভাবের পরিবর্তন জরুরি। মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সমাজের পট পরিবর্তনে তাদের ভূমিকা রাখার উপযুক্ত পরিবেশ সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উচ্চশিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি থেকে শুরু করে যোগ্যতা অনুসারে কাজের ব্যবস্থা ও চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের পরনির্ভরশীলতার দায় থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। এজন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আরো আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন।

সর্বপরি আমাদের মনে রাখতে হবে, জ্ঞানের আলো যদি থাকে অফুরন্ত আর জ্ঞানের ভাণ্ডার থাকে সমৃদ্ধ, তাহলে প্রতিবন্ধিতা কোনো বাঁধা হতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মাত্র দেড় বছর বয়সে দৃষ্টি ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী হয়েও হেলেন কেলার জীবন সংগ্রামে হার মানেননি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রথম অন্ধ ও মূক ব্যক্তি ছিলেন তিনি। লুইস ব্রেইলি নিজে অন্ধ হয়েও অন্ধদের জন্য রেখে গেছেন যুগান্তকারী আবিষ্কার, ব্রেইলি পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস একজন শারীরিকপ্রতিবন্ধী হয়েও প্রজ্ঞার শক্তিতে হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ববরেণ্য। জন ব্রামব্লিট একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও নিজের একাগ্রতা আর সৃজনশীলতার বলে হয়ে উঠেছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর। 

বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট পঙ্গুত্ব বরণ করেও স্থান করে নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়৷ জ্ঞান, পরিশ্রম ও প্রজ্ঞার শক্তি দিয়ে যে পৃথিবীর সবকিছু জয় করা যায়, তাই দেখিয়েছেন এই জ্ঞানপিয়াসী অদম্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। তাই এই সত্য উপলব্ধি করে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন থেকেই শুরু হোক তাদের এই অধিকার রক্ষার আন্দোলন। আর কোনো অবহেলা, বিদ্রুপ নয় পৃথিবী জুড়েই প্রতিষ্ঠিত হোক প্রতিবন্ধীদের প্রাপ্য অধিকার।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।